BANNER

সাবধান, টাইফয়েড বাড়ছে

লেখক: ডা. কাকলী হালদার, সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

সংগৃহিতঃ প্রথম আলো: ১৪ জুন ২০২৩

টাইফয়েড বা এন্টারিক ফিভার পানিবাহিত সংক্রামক রোগ। স্যালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এটি হয়ে থাকে। স্যালমোনেলা দূষিত পানি ও খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। যেকোনো বয়সেই টাইফয়েড হতে পারে, তবে শিশু এবং কম রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষায় সবচেয়ে বেশি এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

যেভাবে জীবাণু ছড়ায়

অপরিচ্ছন্নতা, ঘনবসতি, সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে হাত না ধোয়া, দূষিত পানি বা খাবার খাওয়া, রেস্তোরাঁয় অস্বাস্থ্যকর এবং কম সেদ্ধ খাবার খাওয়ার কারণে এই রোগ বেশি হয়। এ ছাড়া টাইফয়েড জ্বর হতে আরোগ্য লাভ করার পর অনেকের শরীরের পিত্তথলিতে এই জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থেকে যেতে পারে এবং পরে বাহক হিসেবে তিনি রোগ ছড়াতে পারে। যেসব এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে, সেখানে ভ্রমণ করলেও টাইফয়েড হতে পারে। আক্রান্ত রোগীর মলের মাধ্যমে জীবাণু পরিবেশে ছড়ায় এবং অস্বাস্থ্যকর–অপরিষ্কার খাবার, পানি বা হাতের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।

রোগের লক্ষণ

টাইফয়েডের জীবাণু আক্রান্ত ব্যক্তির পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। জীবাণু শরীরে প্রবেশের ১০ থেকে ২০ দিনের মধ্যে সাধারণত রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। জ্বর এ রোগের প্রধান লক্ষণ। পরে নানা অঙ্গ আক্রমণ করে। সময়ের সঙ্গে এর লক্ষণসমূহ পরিবর্তিত হয়।

পাঁচ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুর যেকোনো কারণে জ্বর হলেই খিঁচুনি হতে পারে। মডেল: আজমির 

পাঁচ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুর যেকোনো কারণে জ্বর হলেই খিঁচুনি হতে পারে। মডেল: আজমিরছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রথম সপ্তাহ: প্রথম চার-পাঁচ দিন জ্বর ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, যা কখনো বাড়ে (১০৪ ডিগ্রি বা অধিক ফারেনহাইট) কখনো কমে। তবে কখনোই সম্পূর্ণ ছেড়ে যায় না।

জ্বরের সঙ্গে ক্ষুধামন্দা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, বমি, কাশি থাকতে পারে।

দ্বিতীয় সপ্তাহ: রোগীর পেটে গোলাপি রঙের ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। প্রচণ্ড জ্বরের সঙ্গে কাশি, হৃৎস্পন্দন কমে যাওয়া, পেটে ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, প্রলাপ বকা, রক্তশূন্যতা ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।

তৃতীয় সপ্তাহ: এ সময় যদিও জ্বর কমে আসে কিন্তু চিকিৎসা না হলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।

টাইফয়েডে পরিপাকতন্ত্র ছিদ্র এবং রক্তক্ষরণ হতে পারে। অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ, মেরুদণ্ডে সংক্রমণ, মস্তিষ্কে প্রদাহ, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, পিত্তথলিতে সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোড়া এবং স্নায়বিক সমস্যা সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চিকিৎসা

অ্যান্টিবায়োটিক যথেচ্ছ সেবনের কারণে আমাদের দেশে টাইফয়েড জ্বর অ্যান্টিবায়োটিকরোধী হয়ে পড়ছে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা করে অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসক যেভাবে যত দিন বলবেন, ঠিক সেভাবেই ওষুধ খেতে হবে বা ইনজেকশন নিতে হবে। সঠিক নিয়মে না খেলে বিভিন্ন জটিলতাসহ রোগী বাহক হিসেবেও রোগ ছড়াতে পারে। টাইফয়েডের রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। বেশি বেশি তরল, ভিটামিনযুক্ত এবং উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত। জ্বর বেশি থাকলে নরম গামছা বা তোয়ালে ভিজিয়ে বারবার শরীর মুছে দিতে হবে। তেল-মসলা-ভাজা খাবার পরিহার করতে হবে। প্রতিবার টয়লেট ব্যবহারের পর হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুতে হবে।

প্রতিরোধ যেভাবে

পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকাই টাইফয়েড থেকে বাঁচার প্রধান উপায়। এ ছাড়া নির্ধারিত ভ্যাকসিন বা টিকা গ্রহণ করা যেতে পারে।

বাচ্চাদের ৯ থেকে ১২ মাস বয়সের মধ্যে কনজুগেট ভ্যাকসিনের কেবল একটি ডোজই পর্যাপ্ত। 

২ বছরের বড় বাচ্চাদের পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন এক ডোজ এবং ৩ বছর পরপর বুস্টার দেওয়া যেতে পারে।

ভ্যাকসিন সব সময় শতভাগ কার্যকর হয় না, তাই ভ্যাকসিনের পাশাপাশি যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে—

খাবার প্রস্তুত-গ্রহণ-পরিবেশনের আগে এবং শিশু বা অসুস্থ রোগীকে খাওয়ানোর পূর্বে খুব ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

সব সময় ফোটানো বা পরিশোধিত পানি পান করা উচিত।


শাকসবজি, ফলমূল, ডিম, মাছ, মাংস এবং রান্নার বাসনপত্র ধোয়ার জন্য সব সময় পরিষ্কার পানি ব্যবহার করতে হবে।

যেকোনো খাবার ভালোভাবে রান্না বা সেদ্ধ করে তারপর খাওয়া উচিত।

রাস্তার পাশের দোকানের খাবার খাওয়া এবং পানি বা শরবত পান করা যাবে না।

টয়লেট সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে এবং বাচ্চাকেও শেখাতে হবে।

ভ্রমণ করার সময় বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না ফলে টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

No comments

Theme images by compassandcamera. Powered by Blogger.